লিভার বা যকৃত মানবদেহের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা রক্ত পরিশোধন, হজমে সহায়তা, শক্তি সংরক্ষণ এবং শরীর থেকে টক্সিন অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। তবে দীর্ঘদিন ধরে লিভারে প্রদাহ বা ক্ষতির ফলে এক সময় লিভারের কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায় এবং সেখানে দাগ বা স্কার টিস্যু তৈরি হয়। এই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতপ্রাপ্ত অবস্থাকেই বলা হয় লিভার সিরোসিস (Liver Cirrhosis)।
লিভার সিরোসিস একবার শুরু হলে এটি ধীরে ধীরে লিভারের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয় এবং শেষ পর্যায়ে গিয়ে এটি জীবনঘাতী হয়ে উঠতে পারে। তাই সময়মতো লক্ষণগুলো চিহ্নিত করে একজন অভিজ্ঞ গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
লিভার সিরোসিস কীভাবে হয়?
লিভার সিরোসিস বিভিন্ন কারণে হতে পারে। প্রধান কারণগুলো হলো:
- দীর্ঘমেয়াদী অ্যালকোহল সেবন
- হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস সংক্রমণ
- ফ্যাটি লিভার বা নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়েটোহেপাটাইটিস (NASH)
- জেনেটিক রোগ (যেমন: Wilson’s disease, Hemochromatosis)
- কিছু নির্দিষ্ট ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
- অটোইমিউন হেপাটাইটিস
লিভার সিরোসিসের লক্ষণসমূহ
সিরোসিসের প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তবে রোগের অগ্রগতির সাথে সাথে নানান উপসর্গ ধীরে ধীরে দেখা দেয়। নিচে লিভার সিরোসিসের সাধারণ ও গুরুতর লক্ষণগুলো দেওয়া হলো:
১. দুর্বলতা ও অবসাদ
রোগীরা প্রায়ই দুর্বলতা অনুভব করেন, এমনকি হালকা কাজেও ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
২. ক্ষুধামন্দা ও ওজন কমে যাওয়া
সিরোসিসে খাদ্য হজমে সমস্যা হয়, ফলে ক্ষুধা কমে যায় এবং শরীর দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩. বমি ভাব বা বমি
প্রায়ই বমি বমি ভাব লাগে, বিশেষ করে খাওয়ার পর বা সকালে।
৪. ত্বক ও চোখ হলুদ হওয়া (Jaundice)
লিভার ঠিকমতো বিলিরুবিন প্রসেস করতে না পারলে ত্বক ও চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যায়।
৫. পেটে পানি জমা (Ascites)
লিভার সিরোসিসের একটি গুরুতর লক্ষণ হলো পেটে তরল জমে পেট ফুলে যাওয়া।
৬. চুলকানি (Itching)
রক্তে টক্সিন জমে থাকায় ত্বকে তীব্র চুলকানি হতে পারে।
৭. পায়খানায় রক্ত বা কালো রঙ
লিভার সিরোসিসে রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমে যায়, যার ফলে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ব্লিডিং হতে পারে।
৮. মাথা ঝিমঝিম করা, ঘোলাটে চিন্তাভাবনা
রক্তে টক্সিন জমার কারণে ব্রেইনে প্রভাব পড়ে – একে হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি (Hepatic Encephalopathy) বলা হয়।
৯. বুক ও তলপেটে শিরা ফুলে ওঠা (Varices)
সিরোসিসে ব্লাড ফ্লো ব্যাহত হয়, ফলে ইসোফেগাস ও পেটের শিরাগুলো ফুলে যেতে পারে এবং ফেটে ভয়াবহ রক্তপাত ঘটতে পারে।
১০. পুরুষদের ক্ষেত্রে স্তনবৃদ্ধি ও যৌন ক্ষমতা হ্রাস
লিভার হরমোন মেটাবোলিজমে বাধা সৃষ্টি করলে এ ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়।
কখন গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হবেন?
যদি উপরের যেকোনো একটি লক্ষণ দীর্ঘ সময় ধরে থাকে বা হঠাৎ করে দেখা দেয়, তাহলে দেরি না করে দ্রুত একজন দক্ষ গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ সিরোসিস যত আগে ধরা পড়ে, তত বেশি সুযোগ থাকে চিকিৎসা ও জটিলতা প্রতিরোধের।
লিভার সিরোসিস প্রতিরোধে করণীয়
- অ্যালকোহল বর্জন করুন
- হেপাটাইটিস বি ও সি প্রতিরোধে সচেতন থাকুন এবং টিকা গ্রহণ করুন
- চর্বিযুক্ত খাবার কম খান ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করবেন না
- নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা ও লিভার ফাংশন টেস্ট করান
উপসংহার
লিভার সিরোসিস একটি নীরব ঘাতক, যেটি ধীরে ধীরে শরীরের অন্যতম প্রধান অঙ্গটিকে অকেজো করে দিতে পারে। তাই এ রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা, জীবনধারা পরিবর্তন করা এবং দ্রুত একজন অভিজ্ঞ গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া—এই সবগুলোই সময়মতো করাটা অত্যন্ত জরুরি। আপনার স্বাস্থ্যই আপনার ভবিষ্যৎ।
⚠️ সতর্কবার্তা
লিভার সিরোসিসের যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে নিকটস্থ আধুনিক চিকিৎসা কেন্দ্রে যোগাযোগ করুন। নিজের জীবন বাঁচান, পরিবারকে নিরাপদ রাখুন।