ছোট গল্প- হরির দেশে ফেরত
লেখক-মোঃ আরিফ হোসেন
গ্রামে পাক হানাদার বাহিনী ঢুকেছে। চারদিকে হৈহৈ রৈরৈ সাড়া পড়ে গেলো। এই বুঝি শুনা যায় কারো রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। মিলিটারিরা ক্যাম্প করেছে উত্তর পাড়ার প্রাইমারী স্কুলে। কত রকম তাবু টাঙ্গানো তাতে!
তুফান শেখ প্রতিদিন পাকবাহিনীর খবরা-খবর নেয়।কেনই বা নিবে না। তুফান শেখই তো গ্রামের মাতাব্বর। শেখে’র সারাদিন বাড়ির কাজে মন নাই। মিলিটারিদের সাথে এই পাড়া ওই পাড়া টইটই রইরই করে ঘুরে বেড়ানোই তার কাজ।
আর মাঝে মাঝে কিছু খাবার ও উপরন্তি কামানো। যেমন পাখি শিকারী সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় তেমনি হয়েছে তুফান শেখ। হঠাৎ হঠাৎ সুযোগ পেলে দুএকটা পাখি শিকার করে। তুফান শেখও ঠিক সেরকম।
মিলিটারিরা ক্যাম্প করার পরের দিন গ্রাম ঘুরতে বের হলো। সেকি সাজগোজ! পায়ে শক্ত বুটজুতো, মাথায় লোহার কড়াইয়ের মতো টুপি। হেঁটে চলেছে পূর্ব পাড়া নগেন মুচির বাড়ির দিকে।
ভয়ে আতঙ্কে জোয়ান-বৃদ্ধ-বনিতা সবার বুকে কাঁপুনি শুরু হয়েছে। মিলিটারিদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তুফান শেখ নিজে। সামনে বড় রাস্তার মোরে এসে থমকে দাঁড়ায় মিলিটারিরা।
বিদুনাথের ছেলে হরি বড় রাস্তা ধরে বাড়িতে ফিরছে। অনেকদিন দেশের বাইরে ছিল হরি। মায়ের চিঠি পেয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে আসে নাড়িরটানে। কিন্তু সামনে পরে একদল মিলিটারির।
আর যায় কই। তাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করা হলো মুক্তিফোজ কিনা? মুক্তিবাহিনী কোথায়? কতদিন হলো মুক্তিবাহিনীতে জয়েন করা? হরি কাঁপাকাঁপা গলায় বলে চলছে সে মুক্তিবাহিনীকে চিনে না।
তারপরও মিলিটারীরা তার কথার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না। দলের কে একজন তার হাতের ব্যাগের ভাণ্ডটা খুলে। দেখতে পায় মায়ের জন্য শাড়ি বাবার জন্য ধুতি-পাঞ্জাবি। ছোট বোন কাকুলির জন্য লাল রঙ্গের জামা আর চুড়িফিতা।
আর হরির প্রিয় মানুষটির জন্য একটি সুন্দর বেনারসি শাড়ি। শাড়িটিকে নিয়ে কত স্বপ্ন হরির। এই শাড়ি পরে যখন সুকুন্তি আসবে, আহা! কতই না ভালো লাগবে দেখতে। মনে হবে স্বর্গের পরী বুঝি শাড়ি পড়ে মর্ত্যে নেমে এসেছে।
ক্ষণিকের জন্য কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায় হরি। দেখতে পায় সুকুন্তি পাশে বসে তাকে মিষ্টি পান মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে। মাথার চুল আঙুল দিয়ে আঁচড়িয়ে দিতে দিতে জিগ্যেস করছে হ্যাঁ গো, তুমি অনেকখানি শুকিয়ে গেছো। মনে হয় ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া হয়নি তোমার। নাকি অসুখ করেছিল গো? এসব ভাবতে ভাবতে হরি হঠাৎ তাকিয়ে দেখে “আগুন”।
মিলিটারিরা আগুন লাগিয়ে দেয় কাপড়ের ব্যাগে। হরির কিছু বলার থাকে না। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোটা জল। মিলিটারিরা এতে ক্ষান্ত হয় না। তারা হরির পরনের শার্ট প্যান্ট সব খুলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
হরি বহুবার অনুরোধ করে,হাতে পায়ে ধরে কিন্তু লাভ হয়নি।এমনকি তুফান শেখের পায়ে হাত দিয়ে অনুরোধ করে। কিন্ত তুফান শেখ, মালায়ুনের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা এবং এরকম অকথ্য ভাষায় গালিগলাজ করে।
মুখের উপর বার কয়েক লাথি মারে। মিলিটারিদের ভিতর থেকে কেউ একজন বন্দুকের নলাটা হরির কলিজা বরাবর লাগিয়ে ট্রিগারটি চাপ দেয়। হরির কলিজাখানি ছেদ করে বেরিয়ে যায় একটি বুলেট।
চারিদিকে থমথমে নীরবতার মাঝে গুলির প্রতিধ্বনী ফিরে আসার আগেই শব্দ করে উড়ে যায় কদম গাছের মগডালে বসে থাকা পানকৌড়ির একটি দল। মাঠে চরানো গরুগুলো আতঙ্কে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করে।
আবার সবকিছুকে স্তব্ধ করে দিয়ে ফিরে আসে গুলির প্রতিধ্বনী। এসেই হরির বুকে আঘাত হানে। হরি কল্পনালোকে আবারও হারিয়ে যায়। দেখতে পায় মা সন্তান হারানোর ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। তাকে ধরাধরি করে বোন আর বাবা ঘরে নিয়ে মাথায় পানি ঢালে। তাদের চোখেও ভয়ের অশ্রু।
ধীরে ধীরে হরির চোখ ছোট হয়ে আসে। সে দেখতে পায় সুকুুন্তিকে। পাতলা গড়নের মেয়েটা। একটা বেনারসি শাড়ি পরে কাকে যেন পাগলের মতো এদিক সেদিক খুঁজছে। না পাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
অপরদিকে বেনারসি শাড়িটি বারবার শরীর থেকে পড়ে যাচ্ছে। তাকে আটকানোর সুকুন্তির সেকি প্রচেষ্টা! এসব দেখতে দেখতে হরির প্রচণ্ড হাসি পায়। হাসতে হাসতে নগ্ন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মায়ের একমাত্র কলিজার টুকরো, বোনের একমাত্র আদরের বড় দাদা, বাবার একমাত্র ছেলে, হরি।
হরির দেশে ফেরত ছোট গল্পের বিস্তারিত
মোঃ আরিফ হোসেনের অসাধারণ এক ছোট গল্প “হরির দেশে ফেরত“। গল্পটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের একটি খন্ডচিত্র ধারণ করে।
৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে হরির মতো শত শত মানুষ এভাবেই পাক বাহিনীর হাতে শহীদ হন। শেষ বারের জন্য প্রিয় মানুষগুলোকে দেখার ইচ্ছা তাদের পূরণ হয়নি।
এরকম ছোট ছোট মর্মান্তিক কাহিনী নিয়েই রচিত হয়েছে আমাদের আমাদের স্বাধীনতা। আর তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করতে হবে আমরণ।