ছোট গল্প- রাসুর অসমাপ্ত জীবন
লেখক- মোঃ আরিফ হোসেন
তসলিম উদ্দিনকে নিয়ে মিলিটারির একটি দল বের হয় পশ্চিমদিকে। ওদিকে রহমত চৌকিদারের বাড়ি। মিলিটারিদের উদ্দেশ্য হলো রহমতকে টেনেহিঁচড়ে ক্যাম্পে ধরে এনে আচ্ছামত সাজা দিতে।
কারন মিলিটারিরা গ্রামে আসার পরও রহমত তাদের সাথে দেখা তো দূরের কথা ঢুঁ মেরেও যায়নি। তসলিম উদ্দিন সামনে সামনে পথ দেখিয়ে চলছে। একটু পর মিলিটারিরা দেখলো পথের মাঝে বিশাল চওড়া নদী।
সেকি,তসলিম তো তাদের একথা বলেনি। তারা নিজেরা চিন্তা করলো কি করে নদী পার হওয়া যায়। যদিও একটা সাঁকো আছে। সেটা পিঁজরাপোলের আসামির ন্যায় হয়ে গেছে।
কঙ্কালের শরীরের মত দেখতে সাঁকোর উপর দিয়ে চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তক্তাগুলো মরমরে ভঙ্গুর, পা দিলেই ভেঙে পড়ে নদীতে।
আবার কোথাও তক্তা একদমে নেই। কোথাও কোথাও খুঁটির পরিবর্তে আছে রশি। এমন করে টানা দেওয়া যেখান ধরে সামনে যেতে হয়। আশেপাশে কোথাও সালতি বা ডিঙি নৌকাও নেই। একমাত্র উপায় হলো সাঁকো।
মিলিটারিরা এক এক করে সাঁকো দিয়েই নিজের উপর আর ছেঁড়া কিছু রশির উপর ভরসা করে এগুচ্ছে। সবাই যখন পার হলো সামনে দেখলো ইয়া সুন্দর গ্রাম। মাঠে মাঠে সোনালি ফসল। কোথাও কোথাও ধানের গাদা।
চোখ ঠাঁটানো মনোরম দৃশ্য সত্যি খুব চমৎকৃত করে তুলবে যে কাউকে। কিন্তু মিলিটারিদের হৃদয়ে বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটলো না। দলের লিডার অর্ডার করলেন সমস্ত ধানের গাদায় আগুন লাগিয়ে দিতে।
একজন গিয়ে আগুন লাগায়। দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন। পুড়ে ছাই হয়ে গেল গরীবের রক্ত ঝরানো স্বপ্নের ফসল। মিলিটারিরা সামনে এগুতে লাগলো। বড় রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়লো গলিতে।
সোজা কয়েকশো গঞ্জ যাওয়ার পর বা দিকে মোড় নিল। চোখে পড়লো আনিস মুন্সীর বাড়ির উঠানে হালকা বয়সী একটি মেয়ে। আনিস মুন্সীর একমাত্র মেয়ে রাসু।
মিলিটারিরা ঘেরাও করলো আনিস মুন্সীর বাড়ি। ভয়ে আতঙ্কে রাসু দৌড় দিয়ে ঘরে ঢুকলো। দরজা বন্ধ করে খাটের তলায় লুকায়। মিলিটারিরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখতে পেল আনিস মুন্সীর বউকে। আর সদ্যবিবাহিত ছেলে আবুলের নববধূকে।
পাকবাহিনীর কমান্ডার গুলি করলো রাসুর মায়ের মাথায়। গলাকাটা মুরগির মত লাফাতে লাগলো রাসুর মায়ের শরীর। শব্দে আঁতকে উঠে রাসু। মিলিটারিরা টের পেয়ে যায় রাসু খাটের তলায় লুকিয়ে আছে।
একজন গিয়ে টেনে হিঁচড়ে বের করে রাসুকে। আটজন পাক বাহিনী মিলে শুরু করে তাণ্ডবলীলা। রাসু এবং রাসুর ভাবির শরীরে জড়ানো সমস্ত কাপড় হানাদার দলেরা টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলে।
তখনো রাসুর শরীরে মেয়েলি কোন লক্ষণ ফুটে উঠেনি। মিলিটারিরা একসাথে এতটুকু রাসুর শরীরে দু তিনজন মিলে কামলীলা চালায়। এক পর্যায় মিলিটারিদের পাশবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দেয় রাসু।
সাথে সাথে একজন মুখে কাপড় পেঁচিয়ে দেয়। রাসুর ভাবির মুখেও কাপড় পেঁচিয়ে দেয়। রাসুর মনে হচ্ছে যেনো সে এখনি মারা যাবে।
প্রচণ্ড জলপিপাসা পায় রাসুর। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আল্লাহ আল্লাহ বলে চিৎকার করে। কিন্তু কোন স্বর বাহির হয় না। ধীরে ধীরে রাসু নেতিয়ে যায়।
টানা ৩০ মিনিট পাশবিক নির্যাতনের পর মিলিটারিদের বুঝতে বাকি থাকে না যে রাসু আর এই জগতে নাই। তাদের মনবাসনা পূর্ণ হলে রাসুর ভাবিকে গুলি করে।
বাংলার আলো বাতাস ভারি করে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে যায় দুটো তাঁজা প্রাণ। পাকবাহিনী চলে যাওয়ার সময় ঘরগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
আগুন, আগুন। চারিকে আগুন। দাউদাউ করে জ্বলে উঠে আগুন। পুড়ে ছাই হয়ে যায় ঘরগুলো। সাথে দুটো তাঁজা প্রাণ।
“রাসুর অসমাপ্ত জীবন” ছোট গল্পটির বিস্তারিত
লেখক মোঃ আরিফ হোসেনের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছোট গল্প “রাসুর অসমাপ্ত জীবন“। এই গল্পটি মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম হারানো দুই বোনের কাহিনী।
এই গল্পে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্লজ্জ মানসিকতার দিকটি ফুটে উঠেছে। তারা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তরুণীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
একই সাথে শিশুরা তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। রাসু তাদের মধ্যে একজন (কাল্পনিক)। রাসুরা চলে গেছে এই ধরা থেকে। কিন্তু আমাদের দিয়ে গেছে এই স্বাধীন বাংলাদেশ।
আজকের শিশুদের মাঝেই বেঁচে আছে রাসু। সে মরেও অমর। তার জীবন অসমাপ্ত।