অসময়ে মেহমান | বাংলা গল্প | মোঃ আরিফ হোসেন

অসময়ে মেহমান
মোঃ আরিফ হোসেন

এক নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাবো। সাজগোজ প্রায় শেষ। তবুও মনে হচ্ছে কি যেনো বাকি পড়ে আছে। বারবার মনে করেও মনে পড়ে না। এবারে মনে পড়েছে, প্যান্ট পরেছি বটে কিন্তু কোমরে বেল্ট নাই। এটাও পরা দরকার।

চশমাটা চোখে রেখেই বার কয়েক টেবিলে, টুলে, ওয়্যার ড্রোপে, সো-কেসে, লাগেজে খুঁজলাম। না আর পারা যায় না। কোথায় গেলো হতচ্ছাড়া চশমাটা! নাকি চিলে নিল? শুনেছি কান চিলে নেয়। ভুক্তভোগী চিলের পিছে ছুটে। কিন্তু শেষমেশ দেখা যায় কান তার জায়গায় আছে। মানে মাথাতে।

ওমা! এটা কি? আরে এইতো চশমাটা আমার চোখেই। যাক বাবা! তাড়াতাড়ি পাওয়া গেল। আমার যা ভুলোমন। কোথায় কি রাখি বুঝা মুশকিল। আর আমার একার এমন ভুলোমন নয়। স্বয়ং আইনস্টাইনেরও এমন ভুলোমন ছিলো।

শুনেছি একবার তিনি ট্রেন ভ্রমণে বের হয়ে টিকিট ভুলে কোথাও রেখে আসেন। চেকার এসে টিকেট চেক করতে চাইলে তিনি তাৎক্ষণিক দিতে পারেন নাই। চেকার তাকে চিনতে পারেন। বলেন আপনার টিকিট লাগবে না। আপনাকে চিনতে পারছি।

আপনি টিকিট সংগ্রহ করেছেন এতে আমি শিওর। আইনস্টাইন বললো, তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমি কোথায় যাচ্ছি তা টিকিটটা না পেলে বলতে পারবো না। আর কোথায় গন্তব্য তাও যাওয়া হবে না।

আচ্ছা আমিও কি আইনস্টাইনের মত অতবড় মাপের কেউ হয়ে গেছি? না হলে এতসব ভুলে বসি কেন? শুনেছি বড় মনিষীরা অনেকেই ভুলোমনা স্বভাবের।

আমার সাজগোছ প্রায় শেষ। মাত্র ব্যাগটা হাতে নিয়েছি বের হবো বলে। এমন সময় আমার ঘরে উপস্থিত নাছোড়বান্দা এক মেহমান। মেহমান কিনা জানি না। তবুও তাকে মেহমান সম্মোধন করতে হয়। সে আমার এলাকার বরাক ভাই। সবাই বক ভাই বলে ডাকে। মাঝখানের ‘র’ টা উধাও।

বক ভাই খুবই নাছোড়বান্দা। একবার কারো বাসায় গেলে বের হওয়ার নামগন্ধ নাই। বক ভাই এসেই বললো, মাহবুব ভাই, আপনার সাথে একটু গল্প-সল্প করতে এলাম। একা একা ভালো লাগে না। আপনিও একা থাকেন তাই ভাবলাম…..

তার ভাবনার মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আমি আরম্ভ করলাম, শুনেন বক ভাই, আমি এখন এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাবো। সেখান থেকে তারা আমাকে সাথে নিয়ে বেড়াতে যাবে আরেক আত্মীয়ের বাসায়৷ সেখানে বিরাট একটা অনুষ্ঠান হবে।

অনুষ্ঠানে খাওয়া তো আছে। কিন্তু আমার কপালে খাওয়ার সাথে দাওয়া ঠিকই জুটে যাবে। সেখান থেকে যাবো অন্য কোন আত্মীয়ের বাসায়। এভাবে বেড়াবো এই সপ্তাহ। আপনি এখন যান। আমি এইমাত্র বের হব।

আগেই কইছি, বরাক ভাই নাছোড়বান্দা। কিছুতেই বের হতে চায় না। সে বললো। ভাই এতদূর কষ্ট করে এলাম। না হয় একটু বসেন গল্প করে চলে যাই। অগত্যা বসতেই হলো। মেজাজটা বেজায় টনটনে হয়ে যাচ্ছে। কোত্থেকে আসে এসব উটকো লোক! যতসব গোলমেলে!

বরাক ভাইয়ের সাথে গল্প হলো সল্পও হলো। পান খেলেন পাক্কা তিনবার। চা খেলেন দুবার। ভাগ্যিস আমার রুমে ইলেকট্রনিক ডিভাইসে চা তৈরির ফ্লাস্ক আছে। এর নামটা মনে নাই।

আমার মেহমান নাছোড়বান্দা। তার কাছে আমার বিরক্তির কোন মূল্য নাই। কিছুতেই বের হচ্ছে না। এদিকে আমার খিদেও বেড়েই চললো।

গুষ্টি কিলাই আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া। সাতপাঁচ না ভেবে চাল চড়িয়ে দিলাম চুলায়। আমি একা মানুষ। সবচেয়ে কমদামি চাল দিয়েই চালিয়ে দেই কোনরকম দু-এক বেলা।

অসময়ে মেহমান | বাংলা গল্প | মোঃ আরিফ হোসেন
অসময়ে মেহমান | বাংলা গল্প | মোঃ আরিফ হোসেন
ছবিঃ প্রথম আলো

ওদিকে হয়তো আমাকে সাথে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া জন্য আমার নিকটাত্মীয় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেছে। তা করুক। বক ভাইয়ের মত বকবক করা লোক যার কাছে আছে তার আবার যমের ভয়ও থাকতে হয় না। চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে খোঁজ করতেছি তরকারির জন্য।

‘অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকায়’। আমারও তাই হলো। ঘরে একটুও তরকারি নাই। কাঁচা তরকারি হোক আর আধা কাঁচা কিংবা পাকা হোক কিছুই নাই। এ সপ্তাহ আত্মীয়ের বাড়িতে ঘুরবো বলে কিছুই কেনা হয় নাই। তবে কৌটায় সামান্য একটু ডাল আছে। তা এত সামান্য যে রান্নার উপযোগী নয়।

কিন্তু এ বেলায় কে যাবে বাজার করতে? ঘরে তো বসে আছে বকবক করা বক ভাই। আমি হাজার লোক দেখছি। কিন্তু এর মত ছ্যাঁচ্চোর আর কোথাও দেখি নাই।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাত রান্না হলে এই ডালটুকুতে একটু বেশি পানি দিয়েই চড়িয়ে দিলাম। কলাইগুলো দেখে মনে হচ্ছে ‘ডি’ নদীতে ডুবে যাওয়া তরুণীর মত হাবুডুবু খাচ্ছে। ওদিকে হয়তো আমাকে না দেখে আমার আত্মীয় মাঝ নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে।

ডাল হলো। সেটা ডাল নাকি মুলার জুস তা বুঝা যাচ্ছে না। টলটলে। অনেক পুরাতন হয়েছে বলে উদ্ভট একটা গন্ধও বের হচ্ছে। শাঁকচুন্নি মাছ খাওয়ার পর তার মুখ থেকে যেমন গন্ধ বের হয় ঠিক সেরকম গন্ধ।

ওদিকে কমদামি চাল বলে ভাত থেকেও কেমন একটা গন্ধ আসতেছে। আমার ছোট ঘরটা মনে হচ্ছে গন্ধখানা। আতরখানা নয়, এটা গন্ধখানা।

বক ভাইকে ভাত দিলাম। আমি বসে আছি। বসে থাকার কারণও আছে। আমার ব্যবহারের একটাই প্লেট মাত্র। সেটাতেই তাকে ভাত দিছি। প্লেটটা অতি পুরাতন হওয়ায় চটা উঠে গেছে৷ এক কিনারে ভেঙেও গেছে খানিক। অতেই ভাত দিয়েছি।

ডাল দেওয়ার মত আমার ঘরে তেমন কিছুই ছিলো না। একটা মাত্র বাটি। সেটাতেও লিক হয়ে গেছে। কি করবো, একা মানুষ। তেমন কোন কেনা হয় না।

অগত্যা বক ভাইকে লিক হওয়া বাটিতেই ডাল দিলাম। বাহ্ বরাক ভাইয়ের প্রশংসা করতেই হয়। মনে হচ্ছে সাত দিনের উপসী। ভীমসেনের মত বকাসুরের ভোজন সাবাড় করতেছে।

খাওয়া শেষে বক ভাই মৃদু ঢেঁকুর তুললো। আমাকে বললো খাবার চমৎকার হয়েছে মাহবুব ভাই। আমি না হয় প্রায় এসে আপনার সাথে গল্পসল্প করে খেয়ে যাবো।

আমি মৃদু হাসলাম। ওদিকে হয়তো আমার আত্মীয় তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে আমায় ছেড়ে তার আত্মীয়ের অনুষ্ঠানে চলে গেছে। আহারে বক ভাই! আমার আর আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া হলো না। এসব উটকো লোক ভুতের মত হয়। অসময়ে ঘাড়ে চেপে বসে।

আমার মন আকাশের কালো মেঘের মত হয়ে গেলো। ‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা। কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা।’ আমারও তাই হলো। আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার আর কোন ভরসা নাই। কারণ এতক্ষণে আকাশের পশ্চিম-উত্তর কোণের ঘনমেঘ আমার বাসার উপরে চলে এসেছে।

এবারে বরাক ভাইয়ের টনক নড়ল। ‘পড়িস তো পড় মালির ঘাড়ে, সে ছিল গাছের আঁড়ে।’ বক ভাইয়ের দশা তাই হলো। মরণ ফাঁদে আটকে পড়া ইঁদুরের মত ছটফট করতে থাকে বক ভাই। অনুনয় বিনয় করে আমার কাছে একটা ছাতা ধার চাইলো। কেন জানি বক ভাইয়ের এমন দশা দেখে আমার হাসি পাচ্ছে। মনে হলো টোপটা এবারে গিলছে।

আমার ঘরের একটা কোনায় পড়ে আছে চার বছরের পুরনো ছাতা। এটাকে ছাতা বলা যায় কিনা জানি না। মাত্র ক’টা শিক আছে। আর ডান্ডিটা। তাই পেয়ে বক ভাই খুব খুশি।

আরো পড়ুন……

বলল, অনন্ত মাথাটা বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানো যাবে। ছাতাটা নিয়ে বরাক ভাই ওরফে বক ভাই রুম থেকে বিদায় হলো। এদিকে আমার আত্মীয়ের বাড়িতেও যাওয়া হলো না!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top