চলুন পাল্টাই: পরিবর্তন আনি ভুল নিয়মে

ছোট বেলায় একদিন, তখন খুব সম্ভবত ক্লাস ৩/৪ এ পড়ি। আমি বরাবরই পড়ালেখা কম করতাম। ক্লাস ৩-৪ এ ক্লাসে ১০০ তে টেনে টুনে ৫০ পেতাম। ক্লাসে এমন বাচ্চারা ছিল যারা ৯৯ পেয়েও কান্নাকাটির বন্যা ফেলে দিত।

শিশুদের ব্যাগের বোঝা (পরিবর্তন আনি)
শিশুদের ব্যাগের বোঝা
(পরিবর্তন আনি)

আমার এতটুকু মনে আছে, একবার অংকে ৫৪ পাওয়ায় বাবা গুনে গুনে ৮০ টা বেত্রাঘাত করেছিলেন। রুমের দরজা বন্ধ করে, ৩ ঘন্টা টানা মার খেয়ে আমার চোখ মুখের কান্না শুকিয়ে গিয়েছিল।

এরপর কোচিং এ ভর্তি করালো আমায়। দেখতাম ক্লাসের টপাররা সেই কোচিং এ অনেক আগে থেকেই একটিভ। এরপর স্যার এসে কতগুলা পৃষ্ঠার নোট দিয়ে বলত, “কাল মুখস্ত করে আসবে না, একদম টটস্থ করে আসবে। একটা শব্দও বাদ গেলে কোনো কথা নাই একদম মার”।

আমার তো ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। সন্ধ্যায় বাসায় গিয়ে নোট গুলো নিয়ে বসলাম। পরদিন পড়া পারিনি, দেখলাম আমার সাথের অনেকেই পড়া পারেনি, কিছু টপার বাদে। তারা Word to word মুখস্ত করে আজ বমি করে ফালাচ্ছে৷ আর তাতে বড় বাহবা দিচ্ছে আমাদের অভিভাবকরা।

আমাদের স্কুল কলেজের শিক্ষাক্রম নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু দ্বিমত আছে ওই সব সিস্টেমের উপর, যেখানে টকিং টমের মত বাচ্চারা ইনপুট নিয়ে ওটাই আউটপুট হিসেবে উগড়ে দেয়।

স্কুল জীবনের বেশির ভাগ সময়ই চলে যায় এই ইনপুট আর আউটপুটের বেড়াজালে। কে কত বেশি পৃষ্ঠাভরে লেখলে নম্বর পাবে, কে কত টিচারের কাছে যাচ্ছে । টিচারের কাছে না গেলে তারা নম্বর দিবে না। তাই ১০ টা বিষয়ের জন্য ১০ জন টিচারের কাছে যেতে হবে।

এদিকে বাচ্চারাও কোথাও নিস্তার পায় না। নম্বর না পেলে পানিশমেন্ট, পরবর্তী ক্লাসে উঠতে পারবে না, গার্ডিয়ানের ভয়। অগত্যা তাকে ওই টিচারের কাছেই যেতে হয়। স্কুলে সকাল দুপুরে, কোচিং এ বিকেল রাত পার করে, কিন্তু আউটপুট জিরো। খাওয়ার সময়টুকুও পায় না। সারাদিন পর যতটুকুই সময় থাকে সেখানেও নিজের পড়াশুনা, এসাইনমেন্ট, ফেইসবুক, টিভি এসবে চলে যাচ্ছে। একটা পোল্ট্রি প্রশিক্ষন এর চক্রে বাচ্চারা আটকে আছে।

তবু এই পোল্ট্রির ভেতর দু এক পিস থাকে যারা পোল্ট্রি ট্রেনিং এর থেকে সেল্ফ ট্রেনিং এ বিশ্বাসী। হয়ত এদের ভেতর কেউ সিনিওর কারো সাপোর্ট পায়, কেউ পায় না। কেউ কেউ স্কুল কলেজের বিভিন্ন এক্টিভিটিস এ অংশ নেয়। স্কুল কোচিং এর ব্যস্ত সময় পার করার পরও ফাক থেকে এক্টুখানি সময় বের করে কোনো এক ইন্টারেস্টিং টপিকে কাজ করার। বিভিন্ন সাইন্স ফেয়ার, প্রোজেক্ট ফেয়ার, আইডিয়া কম্পিটিশনে অংশ নেয়।

কিন্তু পরিবারের সাপোর্ট পায় কজন? কিছু বিখ্যাত স্কুল কলেজ বাদ দিলে বেশির ভাগ জায়গায় সেই সাপোর্ট টা পাওয়া যায় না। এরও কারন আছে অবশ্য, বিভিন্ন জায়গায় রিকয়ারমেন্টস থাকে “ জিপিএ-৫” ছাড়া ভর্তি হওয়া যাবে না। আর একারনে অভিভাবক রা উদ্বিগ্ন থাকেন। একারনেই কেউ জেনে শুনেও ছেলেমেয়েদের কোচিং এ পাঠান। সিস্টেমের জালে আটকে এখন আর পথ পাচ্ছেন না।

একদিন বোনের স্কুলে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি প্রায় এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ব্লক হয়ে আছে ট্রাফিক জ্যামে; চারপাশে শুধু গাড়ি আর গাড়ি। ফুটপাতে গিজগিজ করছে মানুষ।

আরো পড়ুন…..

এক শিফটের অভিভাবকেরা তাদের বাচ্চা কাচ্চাদের ভারি ব্যাগ নিয়ে স্কুল থেকে বাসায় যাচ্ছে। আরেক শিফট স্কুলে ঢুকছে। সে এক যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা।

মেট্রোপলিটন এলাকার প্রতিটা স্কুলেই এমন হাজারো মানুষের ভিড় থাকে। এই ছোট ছোট বাচ্চারা সকাল বেলা ভোরে উঠে এত কষ্ট করে স্কুলে যায়। আবার স্কুল শেষে খেয়ে না খেয়ে আবার কোচিং ও করে।

SEPTEMBER 19,  2012 School children with heavy  bag. Photo : K Asif
SEPTEMBER 19, 2012 School children with heavy bag. Photo : K Asif
(পরিবর্তন আনি)

হ্যাঁ এটা বাংলাদেশের বাচ্চারাই করছে, অলস জাতি বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য খাওয়া এই মানুষেরাই ছোট বেলা থেকে এই পরিমাণ খাটা খাটনি করে আসছে যা আদতে মূল্যহীন। মূল্যহীন যে কেন তা পরিষ্কার চোখে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় টোকা দেয়ার যুদ্ধেই দেখা যায়।

যৌবনের প্রারম্ভে

এই সময়ে কৈশোরের সেই উদ্দীপনা পার করে যৌবনের প্রথম ধাপ পার করি। শরীরে আছে তাজা রক্ত, সাথে বুক ভরা সাহসও বয়সের সাথে সাথে বাড়ে। আছে শক্তি সামর্থ্য, চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস ভরপুর। জীবদ্দশার এক চরম পর্যায়ে চলে আসি। সব কিছুই ত আছে, তাও কেন যেন মনে হয় কিছুই নেই, নিঃস্ব।

আশে পাশে তাকিয়ে সুখ পাই না, ভাল কিছু দেখলে মনে জাগে হিংসা। কেউ ভাল কিছু করতে পারলে খুজে ফিরি তার দূর্বলতা। এবং সেটাও না পেলে আকাশ থেকে উড়ে যাওয়া এক ‘দূর্বলতা’র পাখিকে ধরে এনে দেখাই এইযে, এর দূর্বলতা।

এগুলো করে কেমন যেন এক শান্তি পাই। ভেতরে ভেতরে নিজেকে তার থেকে বড় ভাবা শুরু করি। তারপর সেটা নিয়ে কদিন জিকির করতে থাকি। আর একটু বাস্তব হতাশাবাদী হলে চিন্তা করি এই জীবনে কি শিখলাম? কি করলাম?

সার্ভাইভিং পিরিওড

আমাদের দেশের জনগণ প্রায় ১৮ কোটি। এর মধ্যে ০ থেকে ২৫ বছর বয়সী মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০%। (সূূত্রঃ উইকিপিডিয়া)

অর্থাৎ প্রায় ১০ কোটির মত জনসংখ্যা যাদের শিক্ষা জীবন পার করা ম্যান্ডাটরি। এদের ভেতর হয়ত ৬০% মানে প্রায় অর্ধেকের বেশি শিক্ষার সুযোগের নামে পোল্ট্রি ট্রেনিং এ ঢুকে৷ বাকিরা বিভিন্ন কারনে (বেশির ভাগ সময়ে অর্থনৈতিক কারনে) সে সুযোগ টুকু পায় না।

এই ট্রেনিং এর একেক টা পর্যায়ে এদের একটা বড় অংশ ছেটে ফেলেই দেয়া হয়। আর একারনেই ছোট থেকে একটা টার্গেট নিয়ে বাচ্চারা বড় হতে থাকে “You have a lot of competitors and you have to survive for the next level”. যার ফলে ছোট থেকে একজন আরেকজন কে ডাউন দিয়ে উপরে উঠার মত একটা বাজে কম্পিটিশনের অংশ হয়।

এ ধরনের মানসিকতা বাচ্চাদের মনে ছোট থেকে সৃষ্টি হবার পেছনে এই প্রজন্মের অভিভাবক, শিক্ষক সকলেই দায়ী। বর্তমান প্রজন্মের অভিভাবকদের কাছে সাক্সেস মানে হচ্ছে ভুড়ি ভুড়ি নম্বর পাওয়া। আশে পাশের সব কাজ রেখে চেয়ারে আঠার মত লেগে পড়াশুনা করা। আর শেষে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া।

প্রতিটা পর্যায়ে তাদের নীতি থাকে; মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ নিয়ে আসো, এরপর যা ইচ্ছা করো। তারপর উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ নিয়ে আসো, তারপর ভর্তিযুদ্ধে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকো। এভাবে চলতে থাকে এক একটা চ্যালেঞ্জ।

জিপিএ ৫ পাওয়ার পর উচ্ছ্বাস (পরিবর্তন আনি)
জিপিএ ৫ পাওয়ার পর উচ্ছ্বাস
(পরিবর্তন আনি)

মেধার বোঝা

দেশে মেধার কমতি নেই, সম্ভাবনারও কমতি নেই। এত এত সোনার ছেলে মেয়ে দিয়ে ভরপুর এ দেশ। তাও কেন এত অনুন্নত অবকাঠামো? এই বাজে কম্পিটিশন হচ্ছে অনুন্নত অবকাঠামোর কারণ। ছেঁকে ফেলে দেয়ার সিস্টেম হচ্ছে এই অনুন্নত অবকাঠামোর কারন।

এই দেশে দরকার এতগুলো মেধার সঠিক মূল্যায়ন, সঠিক পরিচর্যা। এই পরিচর্যা শুধু অভিভাবকদের করলেই সুফল পাওয়া যাবে না। এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষক, প্রসাশন সকলকেই। এসবের অভাবে আজ এই মেধা দেশে ব্যবহৃত না হয়ে বিদেশে হচ্ছে।

আর এমন টি চলতে থাকলে জাতি হয়ত কোনো একদিন মেধাশূন্য হবে। মেধাশুন্য না হলেও মেধার চর্চার অভাবে গোলাম হয়ে থাকবে কোনো অজানা পরাশক্তির হাতে।

এবার আসুন, পাল্টাই

আমাদের অভিভাবক সমাজ এ হয়ত র‍্যাপিড কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তবে এখন সময় তো আমাদের প্রজন্মর, আমরা যারা সন্তান আছি। আমরাও একসময় বাংলাদেশের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, ভিসি, আমলা, উকিল, ব্যারিস্টার, এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান ইত্যাদি হব।

আরো পড়ুন……

কিন্তু সবাই তো কোনো না কোনো ভাবে কারো অভিভাবক, বাবা মা হব। তখন আমাদের কিরকম মেসেজ থাকবে নতুন ছেলেমেয়েদের প্রতি? এভাবেই কি গড়ে তুলব আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম? নিজেকে একটু প্রশ্ন করুন।

আসুন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সেই পরিবেশ টুকু গড়ে তুলি। যেন তাদের আসলেই প্রকৃত জ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। আসুন বদলে যাই, নিজেদের ভেতর একটু পরিবর্তন আনি । পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হলেও।

চলুন পাল্টাই (পরিবর্তন আনি)

4 thoughts on “চলুন পাল্টাই: পরিবর্তন আনি ভুল নিয়মে”

  1. অনিদ্র মাহমুদ

    মাশাল্লা খুব ভালো লেখেন।এভাবেই ট্রিকব্লগ বিড়ির মাধ্যমে সারা দেশের মানুষকে বদলিয়ে দিন।
    প্রাইমারী শিক্ষকদের জন্য পরামর্শ

    1. কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। সবার সহযোগিতায় আমরা এগিয়ে যেতে চাই। তাজদিদ কএ অনেক ধন্যবাদ এমন একটি পোস্ট লেখার জন্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top