ভূতের গল্প- গায়েবি দোকান
লেখক- মোঃ আরিফ হোসেন
রাস্তা আঁকাবাকা। পাহাড়ি রাস্তা বলেই গাড়িটা টালমাটাল করে চলছে। জনাব এইচ নোমান খান যাচ্ছে খাগড়াছড়িতে। হিসেবী লোক নোমান খান। ড্রাইভারের বাড়তি পয়সা বাঁচাতে নিজেই ড্রাইভিং করছে প্রিয় গাড়িটার। গুইমারা থেকে শুরু হয়েছে পাহাড়। ক্রমশ তা উচু থেকে আরো উচু হচ্ছে। চান্দের গাড়ি নামক এক প্রকার গাড়িতে করে উপজাতীয় নারী পুরুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাচ্ছে। গাড়ির ভিতরে জায়গা না হওয়ায় কেউ কেউ ছাঁদে উঠেছে। তবুও জায়গা না হওয়ায় কেউ কেউ একপ্রকার ঝুলেই যাচ্ছে। তবুও যাওয়া চাই।
নোমান খান যখন মাটিরাঙার ধানপাতাছড়া এলাকায়, তখন প্রায় এশার নামাজের ওয়াক্ত। পাশে মসজিদ নাই। নোমান খান মনে মনে ভাবলেন খাগড়াছড়ি যেয়ে নামাজ পড়া যাবে।
কিন্তু হায়! পাহাড়ি রাস্তায় তেল বেশি লাগে এটা তার জানাই ছিল না। তেলের মিটার লাল হয়ে গেছে। এখনি তেল টাংকির পেটে না ঢাললে গাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। তবুও নোমান খান গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য সামনে যদি কোন তেলপাম্প থাকে বা কোনভাবেই তেল পাওয়া যায়।
তিন কিলোমিটার গাড়ি চলার পর খট্ খট্ করে বন্ধ হয়ে গেলো। আবার চালু করার চেষ্টা। আবার বন্ধ হলো। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এমনি পঞ্চমবার বৃথা চেষ্টা করার পর দেখা গেলো ব্যাটারি সার্টডাউন। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি একচুলো ঠেলে নেওয়া যাবে না। একটু এদিক ওদিক হলে সোজা মরণ খাদে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও কোন গাড়ির সারা শব্দ পাওয়া গেল না। হঠাৎ চান্দের গাড়িও রাস্তা থেকে উধাও হলো। নোমান খান পড়ে গেলেন মহা মসিবতে।
এবার সে গাড়ি থেকে নেমে খোঁজা শুরু করলেন নিরাপদ আশ্রয়ের। গাড়ির যা হয় হোক। কাল সকালে দেখা যাবে। আপাতত এই পাহাড়ি ভয়ংকর রাস্তা থেকে কোন লোকালয়ে যাওয়া যাক। এমনিতে পাহাড়ি বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার কথা পেপারে বা খবরে শোনা যায়। এইতো সেদিন, খাগড়াছড়ি জেলার মহলছড়ির নানিয়ারচর এলাকায় একটা দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হামলা হলো। এলাকাটা ছিল বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাহিত টিলার দু কিলোমিটার দূরে। হামলা চালায় ‘ব্লাক ডগ’ গ্রুপে ‘সোয়াস’ দল।
২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির পার্বত্য শান্তিচুক্তি হয় সেসময় এই ব্লাকডগ গ্রুপটি নিষিদ্ধ করা হয়। এরা সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলা সংগঠন।
মহলছড়ির সেই ঘটনায় প্রায় ৬ জন লোক প্রাণ হারায়। এমন ঘটনা মনে করে নোমান খান শিউরে ওঠেন। গাড়ি থেকে নেমে খুঁজতে থাকেন নিরাপদ আশ্রয়।
কি বাজে ঘটনাটাই না ঘটলো। তেলের মিটার চেক করারও তার খেয়াল ছিল না। এবার মনে মনে যা প্লান করেছে তা বোধহয় আর হয়ে উঠবে না।
পানছড়ি শান্তিপুর অরণ্য কুঠির তার দেখার খুব ইচ্ছা। সেটাও হবে না হয়তো।
পাকা রাস্তার পাশ দিয়ে একটা ইট বেঁচানো রাস্তা গেছে। নোমান খান সে রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেন। এক থেকে দেড় কিলোমিটার হাঁটার পরও কোন লোকালয়ের খোঁজ তার নজরে এলো না। আর এগোনো যাবে না। কারণ হলো মোবাইলের যা চার্জ ছিল তা টর্সলাইট জ্বালিয়ে শেষ হয়ে গেছে। শেষ ভরসা এখন কোন উচু টিলার বসে রাত কাটানো।
সামনেই একটা এবড়োথেবড়ো উঁচু টিলা। নোমান খান যেই টিলায় উঠেছে, দেখতে পেল টিলার গা ঘেঁষে নেমে যাচ্ছে ঝর্ণা। খুব ছোট ঝর্ণা। কিন্তু অনেক উপর থেকে পানি পড়ছে বলে হালকা চাঁদের আলোতেও সুন্দর লাগছে দেখতে। নোমান খান ধীরে ধীরে ঝর্ণার কাছে গিয়ে ওজু করে। নামাজ পড়তে হবে।
ওজু শেষ করেই শুনতে পায় মানুষের গলার আওয়াজ। এই সেরেছে! শান্তি বাহিনী নয়তো আবার? নাকি ইউ.পি.ডি.এফের কেউ? নাকি সংস্কার?
গলার আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। কৌতুহলী নোমান খান ক্ষীণ্ণ গলার আওয়াজ ধরে এগিয়ে যায়। আওয়াজটা একটা বন্ধ দোকানঘর থেকে আসছে। নোমান খান দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। যদি ভিতরে দুই বা তার বেশি গলা শোনা যায় তাহলে যাওয়ার দরকার নাই। কি জানি এরা কারা? কিন্তু আর কোন শব্দ কানে আসছে না তার। এগিয়ে গিয়ে ছোট করে টোকা দেয় টিনের বেড়ায়।
আরো গল্প পড়ুন: ফেসবুক প্রেম
কে? কে ওখানে? (ভিতর থেকে আওয়াজ আসে)
-আমি, একটু বিপদে পড়ছি। এদিকে কোথাও লোকজন পাচ্ছি না। তাই আপনার কাছে এলাম।
আমার কাছে কি?
একটু থাকার জায়গা হবে? আমি অনেকদূর থেকে এসেছি।
আসুন। ভিতরে আসুন। তবে আগুন জ্বালাবেন না। নাহলে বিপদ হবে।
এই বলে ভিতরের লোকটি দোকানের দরজা সামান্য খুলে দিল। যাক বাবা বাঁচা গেল। এই বলে নোমান খান হাঁফছাড়ে।
ধুলোমাখা একটা বেঞ্চের মতো কি যেন পেয়ে সেটাতে ক্লান্ত শরীরটি এলিয়ে দেয় নোমান খান। মনে নানান জল্পনা কল্পনা। লোকটা তার দোকানে থাকতে দিল। অথচ বাতি জ্বালানো যাবে না। এটা কেমন কথা। আবার তার দোকানেও অন্ধকার। বাতি জ্বালালে নাকি বিপদ হবে।
দেখা যাক কি হয়।
কিছুক্ষণ পর নোমান খানের সিগারেটের নেশা চেপে বসলো। সে ভাবলো এই সুযোগে আগুনও জ্বালানো যাবে আর পুরো দোকানটাও দেখা যাবে। কি এমন দাহ্য বস্তু আছে যে বাতি জ্বালালেই বিপদ হবে।
অনেকক্ষণ কেটে গেল। নোমান খান পকেট থেকে সিগারেট বের করলো। সাথে দিয়াশলাই। ফস্ করে এক বাড়িতেই আগুন জ্বালালো সে। তারপর যা দেখলো, সে দৃশ্য দেখে সে মূর্ছা গেল। সে দেখে দোকানে কোন মালামাল নাই। দু একটা টিনের কৌটা পড়ে আছে। আর বাঁশের মাচার উপর শুয়ে আছে মানুষের কঙ্কাল।
আরো গল্প পড়ুনঃ সেই রানা এখন পাগল
সকালবেলা যখন নোমান খানের মূর্ছা কেটে যায় তখন দেখে কয়েকজন শান্তি বাহিনীর লোকের সামনে সে বসে আছে। তারা জ্বানায় পাহাড়ের টিলার উপরে তার গোঙ্গানি শুনে তাকে উদ্ধার করে। নোমান খান তাদের সাহায্য নিয়ে গাড়ির কাছে আসে। আর চান্দের গাড়ির মাধ্যমে তেল এনে সেদিনের মতো খাগড়াছড়ি ত্যাগ করে।
তবে অনেকে তার কথামতো সেই গায়েবি দোকানের খোঁজ করেছিল। কিন্তু কেউ তা খুঁজে পায় নি। তবে স্থানীয়দের মতে, সেখানে নাকি কয়েকবছর আগে অজ্ঞাত কোন রোগে ধনঞ্জয় চাকমা নামে এক মুদি দোকানি মারা যায়।
রক্ত হিম করা ভূতের গল্প (গায়েবি দোকান)
আশা করি, আমাদের এই রক্ত হিম করা ভূতের গল্প (গায়েবি দোকান) আপনাদের খুবই ভালো লেগেছে। আমাদের লেখক মোঃ আরিফ হোসেনের জন্য সবাই দোয়া করবেন। উনি যেনো আমাদের আরো নতুন নতুন ভূতের গল্প উপহার দিতে পারেন। ট্রিক ব্লগ বিডির গল্প সমগ্র দেখে আসতে পারেন।