ধারাবাহিক ভৌতিক গল্প “ভয়ংকর পাতালপুরী” | মো: আরিফ হোসেন | ১ম পর্ব

ভয়ংকর পাতালপুরী” একটি ভৌতিক গল্প। এটি মোঃ আরিফ হোসেনের একটি বিশেষ ধারাবাহিক গল্প। ট্রিক ব্লগ বিডিতে এই গল্পটির একেকটি পর্ব প্রতি শনিবার দুপুর ২ টায় প্রকাশিত হবে। আজকে হচ্ছে ভয়ংকর পাতালপুরী ১ম পর্ব

ভৌতিক গল্প- ভয়ংকর পাতালপুরী ১ম পর্ব
লেখক- মোঃ আরিফ হোসেন

বৃহস্পতিবার কলেজে ক্লাস শেষ হওয়ার পর রাকিব আর মোহন এসে আমাকে শক্ত করে ধরলো। কালকে ওদের সাথে আলুটিলা গুহায় যেতেই হবে। আমি যেতে রাজি না। এমনিতে পকেটের অবস্থাও খারাপ। তার উপরে আলুটিলা গুহা নিয়ে অনেক কথা শোনা যাচ্ছে ইদানীং।

উপজাতিদের ধারণা মতে, এই আলুটিলা গুহা আর দেবতা পুকুর নাকি দেবতাদের দান। প্রতি আমাবস্যায় দেবতারা নাকি পাতালের ঝুলন্ত সিঁড়ি বেয়ে আলুটিলা গুহা হয়ে মাতাই হাওড়ে আসে। মানে দেবতারা পুকুরে গোসল করতে আসে। আবার ভোর হওয়ার আগেই আলুটিলা গুহার সুরঙ্গপথ ধরে সোজা তরতর করে নেমে যায় পাতালে।

তাইতো প্রতি আমাবস্যা রাতে উপজাতি লোকেরা গুহামুখে নানান পুজার ব্যবস্থা করে। পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। বিভিন্ন ফলমূল সাজিয়ে রাখা হয় কলাপাতায়। আর একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। তা হলো বিয়ের উপযুক্ত মেয়েরা সেখানে দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করে। শৌর্যবীর্যশালী বর যেন পায় সেই আশায় মিনতি জানায়।

কিন্তু এসব লোকমুখে শোনা কথা। আমি সেখানে দেবতার পাতালপুরী খুঁজতে কখনোই যাইনি। । অনেকে গেছে। কিন্তু কিছুই পায়নি। না আছে পাতালে যাওয়ার সিঁড়ি, না আছে পাতালের রাস্তা। সুরঙ্গের এক মুখে প্রবেশ করে অপর মুখে বের হওয়া ছাড়া কিছুই নাই।

রাকিব আর মোহনের জোরাজোরিতে রাজি হয়ে গেলাম। প্রকৃতির এমন অপার দান, দেখলেও মনটা ভালো হয়। বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সুরঙ্গ। তা দেখার জন্য সারাদেশের লোক ভ্রমণে আসে।

অবশ্য ইদানীং একটা সুরঙ্গ আবিষ্কার হয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে মেরুং আটমাইল নামক স্থানে। সুরঙ্গটার নাম ‘তবারত হাকর’। বা বাদুড়ের গুহা। দুটো পাহাড়ের মাঝে অতি চমৎকার এই গুহা। দেখলে মনে হয় অতীতের কোন রাজা বাদশাহর রাজবাড়ী। গুহার ছাঁদ ৩০ ফুট উঁচুতে। আর গুহামুখে ছাঁদটা বারান্দার মতো।

শুক্রবার সকালে আমি মোহন আর রাকিব রওনা দিলাম খাগড়াছড়ির দিকে। টিপটিপ বৃষ্টি ছিলো। তাই চান্দের গাড়িতে করে দীঘিনালা থেকে পৌঁনে দশটায় খাগড়াছড়ি পৌঁছাই আমরা। সেখান থেকে আরেকটা চান্দের গাড়িতে করে আমরা গেলাম আলুটিলা পাহাড়ে। সেখানে ২০ টাকা করে টিকিট সংগ্রহ করে ধীর পায়ে চলছি সুরঙ্গের দিকে।

ভয়ংকর পাতালপুরী
ভয়ঙ্কর পাতালপুরী

দীঘিনালায় গাড়িতে চড়ার সময় মস্ত একটা ভুল হয়েছে আমার। গত রাতে বিদ্যুৎ ছিলো না। তাই ফোনেও চার্জ কম ছিলো। তা স্বত্তেও আমি ফেসবুকে লগইন করেছি। বলতে গেলে যেকোন সময় মোবাইল বন্ধ হবে। এই মোবাইলের টর্চ লাইট দিয়ে গুহার অন্ধকার তাড়ানো সম্ভব নয়। আর রাকিব বা মোহনের কাছেও মোবাইল নাই।

মোহন বলল, বন্ধু দেখ, আজকে কেউ বেড়াতে আসে নাই। তেমন লোকজনও নাই, এমনকি কোন মেয়েও নাই। বললাম, মেয়ে দিয়ে কি করবি? মোহন বললো, আরে না। এমনিতে মেয়েরা পরী সেজে আসে তো তাই বললাম আরকি।

সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে নামতে মোহন আর রাকিবের সঙ্গে টুকিটাকি অনেক কথাই হলো। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো এখানেও কোন লোক নাই। পাশেই একটা খোলা দোকান। এদিকে বৃষ্টি হয় নাই বলে দোকানটা এখনো খোলা রাখা হয়েছে। আমি দোকান থেকে একটা কেরোসিনের মশাল নিলাম। যেহেতু টর্চ নাই।

২৬৬ টা সিঁড়ি পেরিয়ে কাদাপানিতে নামলাম। সু জোড়া খুলে হাতে নিয়েছি। তেমন কাদা নাই কিন্তু পানি তো আছে। যে কোন সময় লেগে যেতে পারে। নতুন জিনিসের কদর সবাই জানে। আর জিনিসটা যদি হয় নিজের, তাহলে তো কথায় নাই।

১৮ ফুট ব্যাসের গুহামুখে দাঁড়িয়ে চারপাশটা ভালো করে দেখে নিলাম। গা ছমছমে অনুভূতি। ভয়ও করছে খুব। লোকজনও নাই আজকে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার থেকেও কয়েকশো ফুট নিচে একটা পাহাড়ে একজন জুম চাষীকে দেখা গেলো। পাহাড়ের জঙ্গল কেটে আগুন লাগাচ্ছে। আমরা জানি পাহাড় বন্ধুর প্রকৃতির। উঁচু নিচু পাহাড়ের আড়াআড়িভাবে একইসাথে ধান, গম আদা, যব বা একের অধিক ফসল ফলানোকে জুম চাষ বলে। ওই জুম চাষী ছাড়া আশেপাশে কোন জনমানব নাই।

রাকিব মশাল জ্বালালো। আমরা সামনে পা বাড়ালাম। তিন মিনিট যাওয়ার পর বিদঘুটে অন্ধকার। পায়ের নিচে তরতর করে বয়ে যাচ্ছে হালকা পানির শ্রোত। আমরা গায়ে গা লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। মনে অজানা ভয়। সামনে টুপ করে একটা শব্দ হলো। ‘ওরে বাবা, আজকে আমরা চাপা পড়বো, নিশ্চয়ই পাহাড় ভেঙে সুরঙ্গে পড়বে।’ রাকিব এভাবে চিল্লাতে থাকে। মোহন আমাকে শক্ত করে ধরে।

আমি মশাল হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাই। না, পাহাড় ভাঙবে না। সুরঙ্গের দেওয়ালের গায়ে অসংখ্য ব্যাঙ। তারই একটা টুপ করে বয়ে চলা পানিতে পড়ছে। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। গা ঘেমে গেছে। ভয়ে কিনা জানি না। তবে আরেকটা কারণ আছে। আমরা চলছি ধীরে। আর ভিতরে শীতল হওয়া সত্ত্বেও অক্সিজেন কম। পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পাওয়ায় শরীর ঘামতে শুরু করছে।

মশাল হাতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাবস্যার অন্ধকার মনে হয় এখানকার অন্ধকারের কাছে হার মানবে। কি বিশ্রী অন্ধকা… কথা শেষ না হতেই ঝপাৎ। পা পিছলে পড়ে গেল মোহন। সবার পিছনে সে ছিল। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তাই পাথরের সাথে পা আঁটকে পড়ে যায়। কাদা পানিতে মাখামাখি হয়ে একদম কিম্ভুতকিমাকার অবস্থা। যে কেউ মোহনকে দেখলেই এখন ভয় পাবে।

অবশ্য আমিও একবার এরকম কিছু দেখে ভয় পেয়েছিলাম। তখন খুব ছোট। আমাদের বাড়ির পাশে একজন কৃষক বেগুনের ক্ষেত করেছে। তাতে দাঁড় করিয়ে রেখেছে কাকতাড়ুয়া। কাকতাড়ুয়া থাকলে নাকি মানুষ বেগুন চুরি করে না। এমনকি কোন পাখিও ফসল নষ্ট করে না।

তো একদিন সন্ধ্যায় আমার খুব প্রাকৃতিক ডাক দেয়। খুব ছোট মানুষ। সোজা গিয়ে বেগুনক্ষেতে। যেখানে ভুতের ভয়, সেখানেই রাত হয়। আমারও হলো তাই। কাকতাড়ুয়াকে মানুষ ভেবে পড়িমরি করে দৌড়। এক দৌড়ে বাড়ি। পরে আমার খুব জ্বর হয়। এক জ্বরে সাতদিন। তখন থেকেই আমার সবকিছুর উপরে একটু ভয়টা বেশি।

মোহন পানিতে হাত ভিজিয়ে নিজের প্যান্ট আর শার্টে লেগে থাকা কাদা পরিষ্কার করে। তাতে সময় ব্যায় হলো তিন থেকে চার মিনিট। তড়িঘড়ি করে এবার হাঁটা শুরু করলাম। আমি আগে, মোহন আমার পিছে। আর রাকিব শেষে।

কেরোসিনের মশাল আর হয়তো ৫-৭ মিনিট জ্বলবে। এখনো ১০ মিনিটের পথ। সবে ৬ মিনিট এসেছি। কুম্ভকর্ণ মোহন ব্যঘাতটা ঘটালো। কখনো কাদায় কখনো পাথরে পা দিয়ে অতি কষ্টে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের একমাত্র ভরসা মশালটা। সেটা নিভে গেলে অন্ধকারে হাতরাতে হবে।

এই অন্ধকারে নিজের হাতটাও দেখা যায় না। তড়িঘড়ি করে ৫ মিনিটের মতো সুরঙ্গের পথ ধরে এগিয়ে আসার পর দুটো রাস্তা বের হলো। হ্যাঁ দুটো রাস্তা। একটা ডানে আরেকটা বাঁয়ে। রাকিব বললো বাঁয়ের রাস্তাটাই হবে। আমি এর আগেও একবার এসেছি। আর ডানের রাস্তাটা কিছুদূর গিয়ে বন্ধ হয়েছে।

রাকিবের কথা শুনে আমি সাতপাঁচ না ভেবে বাঁয়ে চললাম। দ্রুত চলতে হবে। দ্রুত না চললে যেকোনো সময় মশাল নিভে যাবে। আরো ৩ মিনিট যাওয়ার পর সামনে পড়লো একটা দেওয়াল। ওমা একি! এই পথ যে শেষ? আমরা ভুল পথে এসেছি। ‘এই রাকিব এই? শালা আমাদের তো ভুল পথে এনেছিস?’

‘কি জানি বন্ধু, আমি তো এর আগে একবার এসেছি। পথ ভুল হলো কিনা বুঝতেছি না।’ মোহন ক্যাৎ করে একটা লাত্থি দেয় রাকিবকে। শালা বদমাশ ভুল তো করেছিস.. কথা শেষ না হতেই হাতের মশালটা নিভু নিভু। ‘এই এই এ-ই গেলো। ‘যা শেষ সম্বলটাও নিভে গেল’। আমরা দুজনের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো রাকিবের উপর।

ভৌতিক গল্প
মশাল হাতে গুহায়

অন্ধকারে আর মাথা কাজ করছে না। কি করবো কই যাবো। এতক্ষণে ফেরার পথটাও ভুলে গেছি। কি বিশ্রী অন্ধকার রে বাবা। অনেক দূরে আমি একটা ক্ষীণ আলো দেখলাম। মনে সামান্য আশার সঞ্চয় হলো। আলোর রশ্মি ধরে অতি মন্থর গতিতে এগুচ্ছি। প্রায় ৪ মিনিট হাঁটার পর সামনে দিগন্তের আলো দেখা দিলো। আলোর পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। আরো ৫ মিনিটের মত হাঁটলাম। কিন্তু কোথায় এর শেষ মাথা?

আমরা চলছি ঠিকই। কিন্তু অন্ধকারে খেয়াল করিনি আমরা কোনদিকে যাচ্ছি। এমনকি উপরে নাকি নিচের দিকে যাচ্ছি তাও স্পষ্ট নয়। এখন মাথায় হুশ এলো। আসলে আমরা নিচের দিকেই যাচ্ছি। শরীর সামান্য ঝুঁকে এসেছে।

‘আমরা মনে হয় আবার ভুল পথে এসেছি।’ পিছনে থেকে রাকিব বলল,
‘তা হবে কেন? দেখছিসনা আলো ধরে এগুচ্ছি আমরা’। মোহনের কথা শেষ হতে আমি ধমক দিয়ে বললাম, চুপ থাক্ তোরা। এটা যদি ভুল পথ হয় তবুও আমি….. কথা শেষ হওয়ার আগেই, পায়ের তলা থেকে মাটি যেন খসে পড়লো। আমরা পড়ে যাচ্ছি। কিন্তু কোথায় পড়ে যাচ্ছি?

নাকি আমরা ভুল পথে এসে সোজা নেমে যাচ্ছি পাতালপুরীতে? কিন্তু কত গভীর এই পাতালপুরী? এতো উপর থেকে পড়লে কি আমাদের হাড়গোড় খুঁজে পাওয়া যাবে?

‘আমরা পড়ে যাচ্ছি!’ চেচিয়ে উঠলো মোহন। ‘শেষবারের মতো মা বাবাকে আর হয়তো দেখতে পারবো না। কেউ বাঁচাও আমাকে।’ রাকিবও আহাজারি করে উঠলো। একমাত্র নির্বিকার আছি আমি। কারণ আমি জানি এরপর কি হবে। অহেতুক চেঁচানো ঠিক না। এর পর সোজা পড়বো কোন এক সাগরে। শুনেছি পাতালে শুধু সাগর থাকে।

আর সাগরে পড়া হলো না। মনে হচ্ছে আমরা ঝর্ণার চিকন রশি ধরে নেমে যাচ্ছি পাতালে। ৫ মিনিটের মত সময় আমরা নেমেই যাচ্ছি। কোথায় পাতাল? কোথায় কি?

অবশেষে পাতালের মাটি খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, পাতালে মাটি এলো কোত্থেকে? আর আমরা পড়তে পড়তেও পড়ছি না কেউ। মাটি থেকে ১০০ ফুট উপরে ঝুলে আছি। ঝুলে আছি বললে ভুল হবে। ঝুলে ঝুলে নামছি।

১ম পর্ব এখানেই শেষ। ২য় পর্ব আসবে আগামী শনিবার দুপুর ২ টায়

অন্যান্য পর্বের লিংক-

ডিসক্লেইমার

“ভয়ংকর পাতালপুরী” একটি কাল্পনিক ভৌতিক গল্প। বাস্তবের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। যদি কোনো ব্যক্তি, স্থান, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সাথে মিলে যায় এটি নেহাতই কাকতালীয়

2 thoughts on “ধারাবাহিক ভৌতিক গল্প “ভয়ংকর পাতালপুরী” | মো: আরিফ হোসেন | ১ম পর্ব”

  1. নাসীমুল বারী

    রহস্য, শিহরণ-সব মিলিয়ে দারুণ এক রহস্যগল্প। হাার্টদুর্বলদের বা ভীতুদের পড়া উচিত নয়। তবে শুরুটা কিছুটা ভ্রমণকাহিনী ধরনের হয়ে গেছে। তারপরও চমৎকার।

    1. আপনার মূল্যবান মতামত প্রকাশ করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। হুম, আপনি ঠিকই বলেছেন। প্রথমদিকটা ভ্রমণকাহিনীর মতোই। তবে যত সামনেরদিকে এগোবেন ততই ভৌতিক আবহ তৈরি হবে। সামনের পর্বগুলো আশা করি আরো ভয়ঙ্কর হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Scroll to Top