অভিমানী বুলবুলি | বাংলা গল্প | মোঃ আরিফ হোসেন

★অভিমানী বুলবুলি
মোঃ আরিফ হোসেন

লিকলিকে দুটো ডাল নিয়ে গ্রামের মাতব্বরের মত গলা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সজিনা গাছটি। চিরল পাতার সবুজের সমারোহে উড়াউড়ি করতেছে দুটো বুলবুলি পাখি৷ অদূরেই বাঁশের মাচায় বসে আছে পারভীন আক্তার রিনা।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বুলবুলি পাখির উড়াউড়ির দিকে। মেয়ে পাখিটি গায়ের পাখাগুলো ফুলিয়ে মুখ গোমরা করে বসে আছে। আকাশে যেমন কালো মেঘে ছেঁয়ে গেলে আঁধার নেমে আসে তেমনই বোধহয় মেয়ে পাখিটির মনটা কালো হয়ে আছে।

ভাদ্র মাসের ঝিরিঝিরি বৃষ্টির হালকা কোমল আঘাতে সজিনা পাতাগুলো মহানন্দে নেচে যাচ্ছে। কোমল আনন্দ উপভোগ করতে কার না ভালো লাগে? সজিনা গাছটারও মনে হয় আজকের ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ভালোই লাগছে। রিনার দৃষ্টি যেন তীক্ষ্ণ। বাঁকা চোখের চাহনি পড়তেই চায় না।

এবারে বুক ফুলিয়ে, টিকলি নেড়ে, ডানায় অসুরের স্বর্গধারনকারী বল নিয়ে সামনে হাজির হলো পুরুষ বুলবুলি পাখিটি। চোখে তার ভয়ার্ত ক্ষুধার্ত অগ্নি। টাইফুনের মত চঞ্চল সে। এই বুঝি হিমালয় মাউন্ট প্রবল ধাক্কায় ভেঙে ফেলবে!

রিনা একটু নড়ে বসলো। রিনরিনে পাতলা মেজাজে প্রচন্ড আবেগে তাকিয়ে আছে সজিনা গাছের দিকে। মনে ভয়, না জানি কি হয়। পুরুষ বুলবুলিটি মনে হয় মেয়ে বুলবুলিটিকে এবার আচার মারবে। কিন্তু না।

যত গর্জে তত বর্ষে না‘। আকাশের এমন ভবিষ্যত বাণীর সাথে তাল মিলিয়ে থেমে গেলো পুরুষ বুলবুলিটি। অর্ধাঙ্গিনীর গা ঘেঁষে একটা লিকলিকে চিকন ডালে বসলো।

অর্ধচন্দ্রাকার আকাশের আলো আঁধারির মত মেয়ে পাখিটির মনটা জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলেও মুখটা গোমরা করেই অপরদিকে নিলো। রিনা বসে আছে প্রচন্ড আবেগ নিয়ে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়।

এই মূহুর্তে কালো মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ভাদ্র মাস। তাই গুড়িবর্ষণ হবে।

পুরুষ বুলবুলি পাখিটির মনেও হয়তো এমন আওয়াজ হচ্ছে। প্রিয়তমার অভিমান ভাঙানো কি এতোই সহজ? পুরুষ বুলবুলিটি এবারে ডানা ঝাপটে উড়ে অপর দিকে গেলো। যেদিকে তার প্রিয়তমা মুখ ফিরিয়ে আছে। কিন্তু এবারও তাকে বড় রকমের শক্ খেতে হলো। প্রিয়তমা এবারও মুখ ফিরিয়ে নিলো।

রিনার চোখগুলো বেয়ে পানি আসছে। সে ভাবে, না-হয় পুরুষ বুলবুলি পাখিটি একটু কষ্ট দিয়েই দিয়েছে। তাই বলে এতো অভিমান!

অভিমানী বুলবুলি

পুরুষ বুলবুলি এবারে ডানায় ভর করে উড়তে লাগলো। প্রিয়তমার সামনে যেয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ঘষলো। মানুষ হলে তো আমরা বলতাম ভালোবাসার চুমু। কিন্তু পাখির বেলায় কি বলা যায় তা আমরা জানি না। রিনা সম্ভবত জানে। তাই সে অশ্রুভেজা কাজল কালো চোখেরজলে ছেঁয়ে যাওয়া মলিন মুখেও একটু হাসলো। এই না হলো পুরুষ! সব পুরুষ এমন হলে কতই না ভালো হত!

মেয়ে বুলবুলিটি উড়িয়ে সজিনা গাছের অপর ডালে বসলো। বীরেশ্বর পুরুষটি হাল ছেড়ে দিল না। সেও পাশে গিয়ে বসলো। হালকা দুলুনিতে সজিনা ডালটি কেঁপে উঠলো। এবার পুরুষ বুলবুলিটি আবারও মেয়ে বুলবুলিটির ঠোঁটে ঠোঁট ঘষতে লাগলো। না, এবারেও মেয়ে বুলবুলিটি মুখ ফিরিয়ে নিলো।

রিনার গায়ে লোম কাঁটার মত দাঁড় হলো। মন চাচ্ছে একটা ঢিল মেরে মেয়ে বুলবুলিটার মাথাটা ভ্যাঁচকাইয়া দিতে। আর পুরুষ বুলবুলিটি মনে হয় বেহায়া। এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে মেয়ে বুলবুলিটি। তবুও সে কঠিন শপথ নিয়ে তার রাগ ভাঙ্গাচ্ছে।

পুরুষ বুলবুলিটি মনে হয় রিনার মনের ভাষা বুঝতে পারলো। চোখে হয়তো নেমে এলো খরস্রোতা নদীর জলোচ্ছ্বাস। কিন্তু পাখির চোখের জল কি লেখক দেখতে পারে? হয়তো রিনা পেরেছে।

পুরুষ বুলবুলিটি উড়িয়ে গেলে দূরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কলাগাছের কঁচি পাতায়। মাঁচায় বসে রিনা মৃদু হাততালি দিলো। মনে মনে বললো, “এবারে ঠিক হয়েছে। মেয়ে হয়ে এতো দেমাগ দেখানো ভালো না। এবার মজা বুঝ্”

অনেকক্ষণ শুনশান নীরবতা। বৃষ্টির ঝিরিঝিরি শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নাই। পুরুষ বুলবুলিটি আর ফিরে এলো না। এবারে মেয়ে বুলবুলিটি এদিক ওদিক পাগলের মতো তাকালো। না, কোথাও নেই। কোথায় গেলো প্রিয়তম? নাকি সে বহুদূরে চলে গেছে? আর কি ফিরবে না?

এবার হয়তো মেয়ে বুলবুলিটির অভিমানের পাহাড় মোমের মতো গলে যেতে লাগলো। হন্যে হয়ে প্রিয়তমকে খুঁজছে সে। না, কোথাও নেই।

আরো গল্প পড়ুন……

রিনার এবার হালকা মন খারাপ হতে লাগলো। এদিকে মেয়ে বুলবুলি পাখিটি তার প্রাণপ্রিয় প্রিয়তমকে দেখতে পাচ্ছে। চোখদুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো। এবার সমস্ত অভিমান ভেঙে উড়ে গেলো প্রিয়তমের কাছে। কিন্তু প্রিয়তম বুলবুলিটিও কম রসিক নয়। সে ঠোকর দিল প্রিয়তমার গায়ে।

আচ্ছা, ভালোবেসে আঘাত করলে কি কেউ ব্যথা পায়? হয়তো পায় না। দুটো পাখি ডানা ঝাপটে উড়াল দিলো অজানায়। রিনা তাকিয়ে আছে তাদের উড়ে যাওয়া মহাশূন্যের দিকে।

পুরুষ পাখিটি প্রিয়তমার অভিমান ভেঙে সঙ্গে নিয়ে গেলো। রিনারও তো আজ বেজায় মন খারাপ। তারও তো একজন প্রিয়তম বুলবুল আছে। সে কি আসবে মন ভালো করতে? সেও কি একরাশ ভালোবাসা বিলাবে এই অভিমানী হৃদয়ে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top