বাপের ভিটা উদ্ধার (বাংলা রম্যগল্প)- মোঃ আরিফ হোসেন

রম্যগল্প- বাপের ভিটা উদ্ধার
লেখক- মোঃ আরিফ হোসেন

খাগড়াছড়িতে তখন আমি একটা কোম্পানিতে চাকরি করি। সুখে দুঃখে, আনন্দে, বিনোদনে, আবেগে, ভালোবাসায় কেটে যাচ্ছিল আমার দিন। হঠাৎ করে সকালের জ্বলজ্বলে আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা নেমে হলো।

মাঝে মাঝে আমার দুচোখের কিনারায় বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। নিরুপায়ে হতাশ হয়ে কোরবানির বকরির মত ছটফট করতে থাকলাম। কখনোই নজরুলের মত গর্জে উঠে বলতে পারতাম না, ‘বল বীর বল উন্নত মম শির।’

আমার একমাত্র দুঃখ হয়ে নেমে এলো কুদ্দুছ আলী। এই আনকোরা পাগল আমার প্রায় কাজে ভুল ধরে। তবে তার ভুল ধরার ভয়ে আমিও ভুল করা ছেড়ে দিলাম।

বাপের ভিটা
সোনার ফসল

কিন্তু আমার দুঃখ একটাই, সে কোন জেলার তা অদ্যবদি জানতে পারি নাই। অনেককে নাকে কানে ধরে, গলায় গলায় ভাব জমিয়ে, চা-পান খাইয়েও কোন কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছিল না। কেউ তার মুখে থেকে জানতে পারতো না সেই কুদ্দুছ আলী কোন জেলার।

তসলিম উদ্দিনের বড় ভাই জগু ছিলো এলাকার বড় বড় মাস্তানের গডফাদার। একদিন তার ডেরায় হামলে পড়লাম। এটাও এক মস্ত পাগল। দু প্যাকেট ব্যানসন সিগারেট পেয়েই পটে গেলো।

কইলাম, ভাই, যেই করেই হোক, ওই আনকোরা পাগলের জেলার নামটা চাই। আমার এই অসম্ভব রকমের কল্পনাশক্তি প্রশংসা করে সবাই হাততালি দিলো।

বললো, যেই করেই হোক, কুদুইচ্ছার হাত পা কুচি কুচি করে কেটে টেবিলে সাজিয়ে রাখুম। বললাম, এই কাজের দরকার নাই। বরং তার মুখ থেকে নিজের জেলার নাম শুনে আসলেই হবে।

জগু বললো, ব্যাটা নাম বলবে না মানে, ওর বাবার নাম ভুলিয়ে দিবো। বললার তার দরকার নাই। ভুলে গেলে তো বলতেই পারবে না।

তিনদিন পরের ঘটনা। সেদিনও চমৎকার সকাল ছিলো৷ গাছে গাছে পাখির গুঞ্জন৷ নদীতে বয়ে যাওয়া কুলুকুলু জলের শব্দ, ঝরে পড়া হাসনাহেনার বিলুপ্ত সুভাশ। সব মিলিয়ে সকালটা যেনো সর্গীয় দান।

এমন সময় দেখি জগু ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে জগিং করছে। বললাম কি হয়েছে জগু ভাই? বললো, ওই ব্যাটা কুদুইচ্ছা আমার বাবার নাম ভুলিয়ে দিছে।

জগুর মুখে মগুর মেরে দেওয়া এমন কথা শুনে হকচকিয়ে গেলাম। তবে কি আমার মনের দুঃখ মনেই থাকবে? না, আর চুপ করে বসে থাকা ঠিক হবে না৷ যা করার নিজেকেই করতে হবে।

ছুটে গেলাম লাইব্রেরিতে। সনেট-ইনেট গদ্য-পদ্য সব জব্দ করে শেষে মুখ কালা করে বসে আছি। না কিছুতেই কিছু হলো না। একটু পরেই দেখি বাংলা ম্যাডাম লাইব্রেরিতে আসলো।

বাংলা ম্যাডাম মানে এলাকার কলেজের ম্যাডাম। আমার মুখ কালা দেখে জানতে চাইলো কি হইছে। ম্যাডামের এমন উৎসাহ দেখে আমার মনের আকাশে একটা ফ্যাঁকাশে নক্ষত্র জ্বলজ্বল করে জলজ্যান্ত হয়ে উঠলো। মনটা চাইছিলো, ম্যাডামের দুহাত আমার দুহাতের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া দুঃখটা বলি।

কিন্তু নিজের সম্যতা বজায় রেখে সামনাসামনি হয়ে বলতে থাকলাম গল্পটা। ম্যাডাম, সামান্য মাথা নাড়েন আর হু হা শব্দ করে আমার গল্পটা শুনেন। এমন মনোযোগী শ্রোতা হয়তো সয়ং রামকৃষ্ণেরও ছিলো না।

সময় গড়িয়ে যায়, পেটের ক্ষিধে বাড়ে, তবু গল্প শেষ হয় না। ম্যাডামের ধৈর্যের প্রশংসা করলে হয়তো চন্দ্র তার তেজ হারিয়ে ফেলবে। নদী তার জল শুকিয়ে ফেলবে তবুও ম্যাডামের ধৈর্যের প্রশংসা করা শেষ হবে না।

বাপের ভিটা উদ্ধার
বাপের ভিটা

অবশেষে ম্যাডাম আমাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে দুহাত নিজের দুহাতে লুফে নিলেন। বুঝলাম বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ‘দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তাহলে দাগই ভালো’। এমন একটা আচমকা বাজনা আমার মনের ঢোলে সুর তোলার চেষ্টা করছে। যাক, তবে বড় কিছু ঘটলো না। ম্যাডাম হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের একটা গল্প বলা শুরু করলো।

আচ্ছা শুনেন, আপনি বরং বঙ্কিমীয় সূত্র অনুসরণ করেন। একবার হলো কি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পাশাপাশি একই জায়গায় থেকে লেখাপড়া করতেন এলাকায় দুজনেরই নাম ডাক ছিলো।

তবে দুজনের মনে ছিলো চমৎকার হিংসা। ভাবতে পারেন হিংসা আবার চমৎকার হয় কিভাবে? বুঝিয়ে বলছি। বঙ্কিম চাইতো শরৎচন্দ্রকে বুদ্ধি আর যুক্তিতে হারিয়ে দিতে। অপরদিকে শরৎচন্দ্রও ঠিক এমনটাই চাইতেন।

একবার গরমের সময় শরৎচন্দ্র একটা শালের চাদর গায়ে দিয়ে, খালি পায়ে রাস্তায় বের হলেন। এই দেখে বঙ্কিম বললো, কি হে শরৎ বাবু? এই গরমে চাদর গায়ে দিয়ে খালি পায়ে কই যাও? এই শুনে শরৎচন্দ্রের মাথা গরম হয়ে উঠলো।

বললো আমি তো আপনার মত বঙ্কিম নই। তাই একটু জগিং করি। বঙ্কিমচন্দ্র একটু লজ্জা পেয়ে সেদিনের মত ক্ষ্যান্ত হলেন। তবে মজার বিষয় হলো এমন চমৎকারী শত্রুতা থাকার পরও, তারা অপরজনের সম্পর্কে কিছুই জানত না। কোথায় নিবাস, কোথা থেকে আসা হয়েছে এসব।

এবার বঙ্কিমচন্দ্রের মাথায় এলো এক বুদ্ধি। একদিন শরৎচন্দ্রের সাথে দেখা হলে গেলে বঙ্কিমচন্দ্রের। তখনো গায়ে শাল জড়ানো ছিলো। হঠাৎ করে বঙ্কিমচন্দ্র শরৎচন্দ্রকে দিলেন এক ধাক্কা।

আরো গল্প পড়ুন……..

ব্যস! কাজ হলো পাক্কা। শরৎবাবু হিতাহিত বোধশক্তি হারিয়ে দিলেন গালি। তখনি বঙ্কিম বুঝে গেলেন শরৎচন্দ্র কোন এলাকা।

আমি ম্যাডামের গল্প শুনে বাসার দিকে দিলাম ভৌ-দৌড়। ইচিং বিচিং চিচিং ছা খেলার মত করে মনটা লাফাচ্ছে। ভাবতেই অবাক লাগছে আজ কুদ্দুছের বাপের ভিটা উদ্ধার করবো।

জমি
জমি

প্রজাতির উড়াউড়ি দেখে মনটা আকুলিবিকুলি করতে লাগলো। আজ কেনো জানি মনে হচ্ছে ডানা মেলা গাঙচিলের মত করে ঝাপটা মেরে উড়ি চলি ওই আকাশে।

বিকাল হতে না হতেই কুদ্দুছের কাছে উপস্থিত হলাম। বুকটা কাঁপে দুরুদুরু। কি জানি কি হবে শুরু। গিয়েই দেখি কুদ্দুছ শালের একটা চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছে। আমার মনটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো।

সর্বশেষ পোস্টগুলো পড়ুন…….

তাহলে কি শরৎবাবু সয়ং এখানে এসেছে। না তা হবে কেনো? কোথায় রাজরাণী, আর কোথায় বাইদানী। কুদ্দুছ আমাকে দেখে যেনো আমাবস্যার চাঁদ হাতে পেলো। কাছে ডেকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ভাই, আমার জন্য বরিশালের একটা ভালো সিট বুকিং দিয়ে আসো তো। আমি বরিশাল যাবো। আমার খুব জ্বর। মনে হয় আর বাঁচবো না। অন্তত শেষবারের মত মায়ের কাছে থাকতে পারবো। মায়ের কোলে মাথা রেখে মরলেও শান্তি!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top